সংবাদ সারাদেশ টোয়েন্টিফোর.কম (আন্তর্াতিক সংবাদ )
বিশ্ব জুড়ে মহামারি কভিড-১৯ মোকাবিলায় মানবতার দৃষ্টান্তের শেষ নেই। ডাক্তার-নার্স-সেবকেরা আত্মোৎসর্গ করছেন, চিকিৎসা পেশায় ফিরে গেছেন আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডা. লিও ভারাদকার, প্রাসাদ ছেড়ে করোনা মোকাবিলায় হাসপাতালে রাজকন্যা সোফিয়া হেম্মেট, বেলজিয়ান নব্বই বছরের করোনাক্রান্ত সুজান হয়লার্টস ভেন্টিলেটর দিয়ে দিচ্ছেন অন্যদের। ‘মানুষের জন্য মানুষ’ এই মানবতার দৃষ্টান্তের শেষ নেই।
কানাডায় অনেক বাংলাদেশি সংগঠন, সংস্থা এবং ব্যক্তি সহায়তার জন্য এগিয়ে এসেছেন এই মহামারি মোকাবেলায়। এই সংকটকালে তারা দীর্ঘ দেড় মাস ধরে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, এই দুঃসময়ে অসহায়দের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, বাড়িয়ে দিচ্ছেন মানবতার হাত।
রাজধানী অটোয়ায় গত ৪ এপ্রিল করোনায় মারা যান প্রথম বাংলাদেশি হাজী শরিয়ত উল্লাহ। এই অটোয়াতে করোনাক্রান্ত সময় যে সব সংগঠন নিরলস ভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে ‘দেশান্তরী’ অন্যতম। যে ‘দেশান্তরী’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যের জন্য, সেই দেশান্তরী এখন সাহায্য করছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।
সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মমতা দত্ত জানান, তারা দুই ভাবেই সহযোগিতা করছেন। দেশান্তরীর পাঁচ শ’ সদস্য ব্যক্তি ভাবে অর্থ তুলে তা ফুডব্যাংকে ডোনেট করা হচ্ছে এবং স্থানীয় বৃদ্ধ কানাডিয়ানদের সাথে যোগাযোগ করে, তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য করা হচ্ছে। তাদের কর্মসূচি এবং কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে বাজার করে দেয়া, ঔষধ-পত্র কিনে দেয়া, রান্নাবান্নায় সাহায্য, বাইরে নেয়া থেকে শুরু করে মার্স্ক-গ্লাফস দেয়া এবং তাদের ভার্চুয়াল নিবোদনের ব্যবস্থা করা।
মন্ট্রিয়ালের সংস্কৃতিক কর্মী বাকী বিল্লাহ বকুল প্রতিদিন কানাডার করোনায় আক্রান্ত-সুস্থ-অসুস্থ-মৃতদের বর্তমান অবস্থার কথা বলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা সব চেয়ে বেশি কুইবেকে। তবে সুখবর যে, এ পর্যন্ত মন্ট্রিয়ালে কোনো বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। এখানে বেশ ক’টি বাংলাদেশি সংস্থা শুরু থেকেই ত্রাণ কার্যক্রমে নিবেদিত। তার মধ্যে বিসিসিএইচসি অর্থাৎ বাংলাদেশ কমিউনিটি কভিড-১৯ হেল্প সেন্টার অন্যতম।
এই সংস্থার মূল উদ্যোক্তা সাইন্ট লাম্বের্টর কলেজে শিক্ষক মাইনুর রহমান সরকার ইত্তেফাককে জানান, আমরা অসহায় মানুষের পাশে ত্রাণের সাহায্য নিয়ে ডোর টু ডোর যাচ্ছি। তবে আমাদের প্রধান কার্যক্রম ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট এবং স্ট্যাটাসহীন অভিবাসী। কারণ, এরা যেহেতু কানাডিয়ান না; তাই আমরা তাদের অবস্থার কথা বিবেচনা করে এই খাত দু’টো বেছে নিয়েছি। কারণ, অন্যান্যদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সরকারি থেকে শুরু করে অন্যান্য সংস্থা কাজ করেছে। কিন্তু যারা করোনার আগে আমেরিকা থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে এখানে এসে আটকে গিয়ে এখনো রিফুজির আবেদন করতে পারিনি তাদের বিষয়টি আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। তাদের জন্য গ্রোসারি, মেডিসিন, ক্যাশ মানি এবং ক্ষেত্র বিশেষে বাড়ি ভাড়ার অংশ বিশেষ সাহায্য হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর নির্বাচনী এলাকা পাপিন্যু রাইডিং’এর অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মাইনুর রহমান সরকার আরো জানান, রশিদ খান, মমিনুল ইসলাম ভুঁইয়া ও শামিমুল হাসান আমরা এক সাথে বিসিসিএইচসি’এর যাত্রা শুরু করলেও পরে আরো কয়েক জন স্বেচ্ছাসেবক যোগ দিয়েছেন। যারা প্রতি নিয়ত কাজ কর যাচ্ছেন।
করোনা ভাইসার প্রথম ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে ভ্যাংকুভারে এবং কানাডায় ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী মারা যায়। সেখানে পরিস্থিতি অনেক উন্নতি হয়েছে। সেখানেও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী দল এবং ব্যক্তি উদ্যোগে কাজ করলেও সাংগঠনিক ভাবে বাংলাদেশি কানাডিয়ান-কানাডিয়ান বাংলাদেশি (বিসিসিবি) যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। বিসিসিবি’র সদস্য কবি ও অনুবাদক শাহানা আকতার মহুয়া সংগঠনের ভ্যাঙ্কুভার চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট প্রসাদ পালের বরাত দিয়ে ইত্তেফাককে জানান, মূলত বাংলাদেশ কম্যুনিটিকেই ফোকাস করা হয়েছে। বয়স্কদের গ্রোসারি করে দেয়া, নানাভাবে তাদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া অব্যাহত আছে। যারা আইসোলেশনে থাকছেন- তাদেরকেও যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। গ্রোসারি কেনা, খাবার তৈরি করা থেকে শুরু করে সবরকমের সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সে সব বাংলাদেশি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জব নেই, তাদেরকে খবর পাওয়া গেল বাংলাদেশি একজন স্টুডেন্ট খাবার থেকে শুরু করে ঠিক ফ্যামিলি মেম্বার হিসেবে সাপোর্ট দেয়া হচ্ছে।
এ ছাড়াও বিসিসিবি’র তৈরি করা মাস্ক, পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এবং মানসিক শুশ্রূষার জন্য আয়োজন করছে লাইভ মিউজিক, চিয়ারিং ইভেন্টস।
ম্যানিটোবা প্রদেশে সেভাবে করোনার প্রভাব নেই। সেখানে মাত্র ২৭১ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আর মারা গেছেন ৬ ব্যক্তি। তবে জরুরি অবস্থার কারণে সব কিছু লকডাউন। ফলে ইউকিপেক শহরেও সবাই গৃহবন্দি। সেখান থেকে মোহাম্মদ সাকিবুর রহমান খান এই প্রতিবেদককে জানান, এই ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বিপাকে আছে এখানকার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশিরা। অনেকে বাংলাদেশ থেকে টাকা আনতে না পারার কারণে কিছুটা বিপদে আছে। তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে কানাডিয়ান বাংলাদেশি এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ, ম্যানিটোবা। সেজন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানিটোবা এবং ইউনিভার্সিটি অফ উইনিপেগের বাংলাদেশি স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের কাছ থেকে বিপদে পড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা নিয়ে তাদের বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে বাজার করে দিয়ে আসছে। সি বি এ’এর ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদুন নবী আরো জানান, আমরা বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছ থেকে ডলার উঠিয়ে এই সাহায্য করছি। ফলে আমাদের এই সব সন্তানেরা নিরাপদে আছে।
আবার ব্যক্তিগত ভাবে কানাডায় এবং বাংলাদেশ দুই জায়গাতেই সাহায্য করছেন অনেকে। এদের মধ্যে একজন অপি মাহমুদ জানান, তার মেয়েরা স্টুডেন্ট জবের বেতন থেকে ঢাকায় ডোনেট করেছে। তিনি স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের রান্না করে খাবার সরবরাহ করছেন এবং ঢাকার ভাড়াটের এক মাসের বাড়িভাড়া মওকুফ এবং ঢাকার অফিসের কর্মচারীদের দু’মাসের বেতন দিয়ে দিয়েছেন।
আবার কভিড-১৯-এ ক্ষতিগ্রস্তদেরকে সাহায্যের অন্য রকম ঘটনাও আছে। যেমন অটোয়ার শরীফ হাসান জানান, তাদের পুত্র অরিক হাসানের চতুর্থ জন্মদিন আগামী ০৮ মে উপলক্ষে একটি তহবিল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর বন্ধু এবং স্বজনেরা নগদ অর্থ উপহারের ঠিক সমপরিমাণ অর্থ যোগ করে তা দেশে এর্শাদ-আম্বিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দরিদ্রদেরকে ত্রাণ প্রদানে ব্যবহার করা হবে।
গত ২৫ জানুয়ারি উহান থেকে আসা এক নাগরিকের শরীরে বৈশ্বিক মহামারী ভাইরাসটি কানাডাতে প্রথম ধরা পড়ে এবং মার্চের ২য় সপ্তাহে সেটির সংখ্যা দুই শতাধিকে ছাড়িয়ে যায়। WHO’র পরামর্শ অনুযায়ী জানা যায় যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধের সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে সংক্রমিত বা ভ্রমণরত মানুষদেরকে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে রাখতে হবে। সেই সময় থেকেই টরন্টোতে একাধিক সংগঠন ও সংস্থা সেবামূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে সিসিএসএস অন্যতম।
সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা নওশের আলী এ সম্পর্কে ইত্তেফাককে জানান, কোয়ারেন্টাইন অথবা আইসোলেশনের কথা ভেবে প্রথমে গত ১৪ মার্চ আমি, সবিতা সোমানি, রেজাউল ইসলাম এবং নয়ন হাফিজ এক আলোচনায় বসি। বসার পর আমাদের আলোচনা একটি বিন্দুতে মিলে গেল যে, আমরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবো। তবে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ পত্র এবং নিত্য ব্যবহার্য জিনিষ পত্র কোথা থেকে আসবে। এই চিন্তা মাথায় রেখেই আজকের এই ‘করোনাভাইরাস কমিউনিটি সাপোর্ট এন্ড সার্ভিস অর্থাৎ সিসিএসএস নামক মানবিক সংগঠনটি গঠন করা হয়েছিল। সংগঠনকে ত্বরান্বিত করতে টরন্টোসহ আশে পাশের শহর মিল্টন, মিসিসাগা, ব্রাম্পটন, ভন, রিচমন্ড হীল, মারখাম, এজ্যাক্স, পোর্ট ইউনিয়ন, অটোয়াসহ শহরের নিবেদিত প্রাণ ৭০ জন মানুষ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
শুরুতে মার্চ ব্রেকের ছুটিতে কানাডার বাইরে থেকে আসা মানুষগুলো যখন নিজ শহরে ফিরে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে থাকেন, তাদের দোরগোড়ায় গ্রোসারি, ওষুধ এবং খাবার সরবরাহ করে এই সংগঠনটি। পরবর্তীতে সিসিএসএস টিম বয়োবৃদ্ধ পরিবার, অসুস্থ মানুষ, গর্ভবতী মা এবং ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ এবং গ্রোসারি ব্যবস্থা করে চলেছে।
এ ছাড়া এই টিম যখন জানতে পারে যে হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, নার্স সহ ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের মাস্কের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে এবং হাসপাতাল থেকে এ ব্যাপারে কমিউনিটি থেকে ডোনেশন চাওয়া হচ্ছে। তখন কমিউনিটির বিভিন্ন বিত্তবান লোকের ডোনেশনে বিভিন্ন হাসপাতাল এবং বৃদ্ধাশ্রমে আমরা কোয়ালিটি সম্পন্ন সারজিক্যাল মাস্ক ডোনেট করেছি এবং এখনো করছি। আশা করছি, একত্রে ‘আমরা করবো জয়’ এই স্লোগানে সিসিএসএস এগিয়ে যাচ্ছে; একটি সুস্থ, সবুজ পৃথিবী জন্য এবং একটি সুন্দর সকালের জন্য।
Leave a Reply