সময়ের সাথে ডেস্ক রিপোর্টঃ
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণে সংস্থাটির অনুমতি লাগে। আবার সরকারি এই সংস্থা ভূমি উন্নয়ন করে প্লট আকারে বিক্রি করেছে। রয়েছে ফ্ল্যাটের ব্যবসাও। এসব কাজে বিশেষ করে ভবন নির্মাণে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয় গ্রাহকদের। ভবনের অকুপেন্সি সনদ (ব্যবহার ছাড়পত্র), নির্মাণ ও স্থাপত্য অনুমোদন, উচ্চতা কমানো-বাড়ানোÑ সবকিছুর এখতিয়ার সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের। এ ছাড়া কমমূল্যে প্লট বরাদ্দ দিয়ে সবার জন্য আবাসন নিশ্চিতেও কাজ করছে রাজউক। সেই সুযোগ নিয়ে রাজউকে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এই চক্রে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) রাজউকের এসব দুর্নীতিবাজকে খুঁজে বের করতে জোর দৃষ্টি দিয়েছে।
দুদকের এক চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজউকের ১২ জন তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বিরুদ্ধে স্বল্প চাকরি করেও অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের
অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের জন্য ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বক্তব্য শোনা ও গ্রহণ করা হবে।
সম্প্রতি পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমানের দুর্নীতি কা-ের পর আতঙ্কে রাজউকের দুর্নীতিবাজরাও। এরই মধ্যে গত ৩ জুলাই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) মো. মোবারক হোসেন ও তার স্ত্রী সাহানা পারভীনের নামে মামলা করেছে দুদক। এরপর থেকে রাজউকের দুর্নীতিবাজরা আতঙ্কে দিন পার করছেন।
রাজউক ভবনে কর্মরতদের একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের রেকর্ড গোয়েন্দা সংস্থার হাতে রয়েছে। সেগুলো যাচাই করতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) উজ্জ্বল মল্লিকের বিরুদ্ধেও। তিনি শুরু থেকে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) ছিলেন। এই প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে সবকিছুর দেখভাল ছিল তার হাতে। তিনি নিজে পূর্বাচলে গ্রিন জোনে সাড়ে ৭ কাঠার একটি প্লট নেন। এ ছাড়া পূর্বাচলের কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান ড্যাটেক্সের নামে আরও একটি প্লট নেন। সেটিও সাড়ে ৭ কাঠার। পূর্বাচল ৫ নম্বর সেক্টরের ১০৩ নম্বর সড়কের ৯১ ও ৯৩ নম্বর প্লট দুটিও তার। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তিনি পূর্বাচলের ক্ষতিগ্রস্ত ১ হাজার ৪৪০ প্লটের আইডি নিয়ে জালিয়াতির চক্র গড়ে তুলেছিলেন। এজন্য তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়েছিলেন। বিষয়টি রাজউক কর্তৃপক্ষের নজরে আসায় পরে লটারির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের প্লট দেওয়া হয়। এই কাজটি করা হয় এমআইএসের মাধ্যমে। এ ঘটনায় উজ্জ্বল মল্লিককে গ্রাহকের টাকা ফেরতও দিতে হয়েছে বলে জানা গেছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, উজ্জ্বল মল্লিকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্তে দুদকের একটি টিম গঠন করা হয়। ওই টিম গত বছরের ৩ মে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে পূর্বাচল প্রকল্পে কর্মরত থাকাকালীন লেক, মাটি ভরাট, ঊর্ধ্ব রাস্তা নির্মাণ এবং ঊর্ধ্ব ড্রেন নির্মাণ সংক্রান্ত নথির সত্যায়িত ফটোকপি এবং ৫ নম্বর সেক্টরের লেক ভরাট সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি চাওয়া হয়। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুদক।
এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান, হুমায়ুন খাদেম, প্রকৌশলী এম আজিজুল হক, সাবেক সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম নুরুল হক, সাবেক পরিচালক আব্দুর রহমান ভূঞা, অফিস সহকারী জাফর সাদেক, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আব্দুল মোমিন, নকশাকার এমদাদ আলী, ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সহকারী অথরাইজড অফিসার আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী বাবু, সার্ভেয়ার মাসুম বিল্লাহ, সুপারভাইজার খালেদ মোশাররফ তালুকদার রুবেল, বেঞ্চ সহকারী বাশার শরীফ, নি¤œমান সহকারী ইউসুফ মিয়া, অফিস সহকারী এমআইএস শাখা বেলাল হোসেন চৌধুরী রিপন, নকশাকার শহীদুল্লাহ বাবু, কনিষ্ঠ হিসাব সহকারী মোহাম্মদ হাসান, নকশাকার শেখ ফরিদ, রেকর্ডকিপার মো. ফিরোজের বিরুদ্ধেও।
এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ৩ জুন দুদকের একটি টিম একজন ইমারত পরিদর্শককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বলে জানা গেছে। আবার রাজউকের প্রশাসন শাখার নথিরক্ষণ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০ ফাইল নিয়ে অনিয়মের লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। রাজউক প্রশাসন বিভাগ থেকে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.) আমাদের সময়কে বলেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রাজউকের অবস্থান পরিষ্কার। দুদক চার্জশিট দিলে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিধি মোতাবেক বরখাস্ত হবে। তবে আমরা এখনো ওই পর্যায়ে যাইনি।
রাজউকের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুদক। এ বিষয়ে সংস্থার বক্তব্য জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, অভিযোগ যে কারও বিরুদ্ধেই থাকতে পারে, সেটি যাচাই করতে হবে। দুদক কীভাবে তালিকা করেছে সেটা বলতে পারব না। অনেকে শত্রুতার বশেও অভিযোগ করে। তাই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যায় না। বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং দুদকের তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, তদন্ত হয়েছে; কিন্তু দুদক অফিসিয়ালি এখনো কিছু জানায়নি।
Leave a Reply