নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী ও মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতারের বিরুদ্ধে মানিকগঞ্জে বহুল আলোচিত ‘খেজুর গাছ প্রকল্প’ থেকে ৩ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠেছে। এছাড়া বালু মহাল, বিভিন্ন হাট-ঘাট ইজারা, লঞ্চ-বাস-ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহন সংগঠন, ইটভাটা, জলমহাল, চাকুরির নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন ক্রয় কমিটির কমিশনও নিয়েছেন বলে জানা গেছে । রাষ্টীয় দায়িত্বের চেয়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে বেশি তৎপরতা, বিরোধী দলীয় বা মতের মানুষদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করারও অভিযোগ রয়েছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনের সকল অপকর্মে সহযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ওঠেছে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে ওঠে আসা এই ডিসির বিরুদ্ধে।সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সরকারি প্রকল্প এসেনসিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানী লিমিটেডের কারখানা স্থাপনের জন্য জমি ক্রয় সংক্রান্ত শত কোটি টাকার দুর্নীতির গোপন রহস্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর তখনই মুহাম্মদ আব্দুল লতিফকে সরিয়ে মানিকগঞ্জে ডিসি করা হয় রেহেনা আকতারকে।
রেহেনা আকতার মানিকগঞ্জে বিখ্যাত হাজারী গুড় উৎপাদন বৃদ্ধি ও এই ঐতিহ্যবাহী পণ্যটিকে ব্যাপকভাবে প্রচার করার জন্য জেলার বিভিন্ন স্থানে খেজুর গাছের চারা রোপন, রক্ষণাবেক্ষণ, সভা-সেমিনার, প্রদর্শনী করে বেশ সাড়া ফেলেন। জেলাবাসী তার এই উদ্যোগকে প্রথমে অভিনন্দনও জানায়। চলতি বছরের ২রা ফেব্রুয়ারি জেলার হাজারী গুড় উৎপাদনকারী এলাকা হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকার হাজারী গ্রামে হাজারী পল্লী নাম দিয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে অনুষ্ঠান করে। গুড় চাষীদের বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার ঘোষণাও দেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
২৭তম বিসিএস-এর এই কর্মকর্তা গত ২০২৩ সালের ২৪শে জুলাই মানিকগঞ্জে জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুন্নাহার হলের ছাত্রলীগের হল শাখার সহ-সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন বলেও জানা যায়।
এ সময় ডিসি রেহেনা আকতার ঘোষণা করেন করেন, গাছী কতগুলো গাছ থেকে গুড় উৎপাদন করেন সেই মোতাবেক তাদের কম সুদে ঋণ দেয়া হবে। এলাকায় সুপেয় পানির জন্য পাম্প স্থাপন করা হবে। সেই সময় দরিদ্র গাছীরা অনেক খরচ করে তাদের মেহমানদারী করেন। তাদের কাজের অনেক ক্ষতি করে ডিসিকে সময় দেন।
এরপর গত ৮ই ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ বিজয় মেলার মাঠে ধুমধাম করে হাজারী গুড় প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করে সকল গাছীকে ডাকা হয়। তাদের দেখানো হয় বড় বড় স্বপ্ন। এতে প্রধান অতিথি হন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আর সভাপতিত্ব করেন বিভাগীয় কমিশনার মো. সাবিরুল ইসলাম।
এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ডিসি ঘোষণা করেন, জেলায় নতুন করে ৫ লক্ষ খেজুর চারা লাগানো হবে। পরে এটাকে বৃদ্ধি করে বলা হয় ৭ লক্ষ চারা লাগানো হবে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, চারা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও এ সংক্রান্ত কাজের জন্য এলআর ফান্ডের (লোকাল রিসোর্স ফান্ড ) নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি করা হয়েছে। এসব বিষয়ের সাথে সরাসরি জড়িত আরেকজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, পুরো জেলায় নতুন করে লাগানো ৫ হাজার খেজুর গাছের চারাও বেঁচে নেই। এটা শুধুই ডিসির প্রমোশন আর টাকা আয়ের একটা মতলব। জেলার বিভিন্ন খাত থেকে টাকা নেয়া হয়েছে এই উদ্যোগের কথা বলে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, বালুমহাল, বিভিন্ন পরিবহন সেক্টর, ইউনিয়ন ভূমি অফিস, উপজেলা ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে খেজুর প্রকল্পের নামে চাঁদাবাজি।
একে তো আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ে তার হাত রয়েছে, অপর দিকে নিজেই ছাত্রলীগ নেত্রী ছিলেন। এই ভয়ে কেউ ডিসির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে পারেননি। তাছাড়া তিনি সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দিয়েই এলআর ফান্ডের নামে ব্যাপক দূর্নীতি করেছেন বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
হাজারী গুড় উৎপাদন সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান শামীম হাজারী বলেন, আমাদের কোনো গাছীকেই কোনো ঋণ দেওয়া হয়নি এবং পানির পাম্পও দেয়া হয়নি।
প্রতিটি খেজুর গাছের চারা রোপনে কত টাকা খরচ হয়েছে? এ টাকাগুলো কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে? এসব নিয়ে কথা বলতে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে বেলা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। বারবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) তারিকুল ইসলাম বলেন, অফিসে এসে স্যারের সাথে কথা বলেন। তাকে অনুরোধ করা হয় যেন ডিসি ফোন ধরেন। কিন্তু অনেকবার ফোন করলেও ডিসি তা রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও ডিসি কোনো উত্তর দেননি। তবে রাত ৮টা ৩৯ মিনিটে ডিসি ফোন করে তার বিরুদ্ধে উখাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এ সময় তাকে প্রশ্ন করা হয় আপনি কি ঢাবির সামসুন্নাহার হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন? তিনি উত্তর না দিয়ে বলেন, আমার একটাই পরিচয় আমি মানিকগঞ্জে ডিসি। এ সময় তিনি বলেন, সব চারা লাগানো হয়নি। এটা একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আর এই চারাগুলো লাগিয়েছেন বিভিন্ন এনজিও, স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। এ সময় খেজুর গাছের চারা রোপণের নামে চাঁদাবাজির বিষয়টিও অস্বীকার করেন তিনি।
Leave a Reply