মো. জয়নাল আবেদীনঃ
গণতান্ত্রিক পুলিশিংয়ের ধারণাটাই বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মধ্যে নেই এবং তারা এটা বুঝতেও চায় না। বুঝতে যতটুকু চায়, এর চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, সরকার ও রাজনৈতিক উদ্দেশের কারণে তারা সেটা পারে না। এখানে মূলনীতি হচ্ছে- নাগরিক ও রাষ্ট্রের প্রতি তার শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও অধিকারগুলোকে যথাযথভাবে নির্ণয় করা। আসল কথা হচ্ছে, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন পুলিশ গঠনের জন্য যেটা দরকারি, সে বিষয়গুলো হলো- নাগরিকদের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রত্যেক মানুষের জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নাগরিকের যে অধিকার ও ন্যায্যতা সেগুলো প্রতিষ্ঠা করাই হলো ডেমোক্রেটিক পুলিশ বা গণতান্ত্রিক পুলিশ। পুলিশ বাহিনীকে জনমুখী করে তোলার তাগিদ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। পুলিশের ওপর জনআস্থার ঘাটতি থাকলে তাকে যে ফরমেটেই আনা হোক না কেন, তারা তাদের কাজে বড় কোনো সাফল্য দেখাতে পারবেন না। বর্তমানে তাদের মধ্যে ‘গণতান্ত্রিক পুলিশিংয়ের ধারণা অনুপস্থিত বলে মনে করেন তারা। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো পুলিশ বাহিনীতে চলছে সংস্কার । স্বাধীনতার পর থেকে পুলিশ বাহিনী দেশের জন্য নিরলসভাবে কাজ করলেও বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পুলিশ বাহিনী সরকার তার মনের মতো ব্যবহার করার কারণে পুলিশ সমালোচিত হয়েছিল বার বার। পুলিশের জনবল, সুযোগ-সুবিধা ও কাঠামোগত এসব উন্নয়ন বাহিনীকে জনমুখী করে তুলতে পারেনি। কারণ, জনগণের কল্যাণের চেয়ে পুলিশকে খুশি করার চেষ্টাই ছিল বেশি। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে বাহিনীর বড় অংশ দলীয় কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। নির্বাচনে জিততে দলীয় নেতাকর্মীদের পরিবর্তে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বিগত সরকার।প্রথমত, পুলিশ সদস্যদের বদলি, পদোন্নতি, নিয়োগ, কার্যক্রম পরিচালনা এবং সঠিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকে সেবামুখী করতে এবং মামলা ও এর তদন্ত, গ্রেপ্তার এবং অভিযানসহ সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির আওতায় আনতে শক্ত কাঠামো তৈরি করতে হবে।বাংলাদেশ পুলিশ অন্যান্য দেশের পুলিশের মতো নয়। এদেশের ইতিহাসে দেখা গেছে যে, যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, অধিকাংশ সময়ই তারা সংশ্লিষ্ট দলের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। গত ৫৪ বছরে পুলিশ বাহিনী বরাবরই নেতিবাচক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনের সময় পুলিশ বাহিনীকে সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনীতে পরিণত করার যে নজির তৈরি করা হয়েছে, তা অতীতের যে কোনো সময়ের কলঙ্কজনক অধ্যায়কে ছাপিয়ে গেছে।এ জন্য পুলিশ-সংক্রান্ত কিছু আইন ও বিধান যুগোপযোগী করতে হবে।
কারণ, জনগণের কল্যাণের চেয়ে পুলিশকে খুশি করার চেষ্টাই ছিল বেশি। যদিও অতীতে পুলিশের পেশাদার হতে না পারার পেছনে জনবল সংকট, বাজেট স্বল্পতা ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখানো হতো। তবে ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৩) এই ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। এ সময় পুলিশে ৮৩ হাজার ৭০টি পদ সংযোজন করা হয়। ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য উচ্চপর্যায়ের ১৭৮টি পদ সৃষ্টি করা হয়। এক লাখ ২০ হাজার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। এই জনবলের বড় অংশই নেওয়া হয় দলীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায়। জননিরাপত্তা বিভাগের গত নভেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে পুলিশের মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ১৩ হাজার।
২০০৯-১০ অর্থবছরে পুলিশের বরাদ্দ ছিল তিন হাজার ৩৩১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই বরাদ্দ ৪৩৩ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে হয় ১৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার বেশি। এ সময় উলেস্নখযোগ্য অবকাঠামো নির্মাণ হলেও এর বড় অংশই ছিল অপরিকল্পিত। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেনএদিকে পুলিশকে সচল করতে জবাবদিহির স্থায়ী কাঠামো তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। তার পরামর্শ, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের পাশাপাশি পুলিশ অভিযোগ কমিশন গঠন করতে হবে। নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতিসহ পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে স্বাধীনভাবে কাজ করবে পুলিশ কমিশন। অভিযোগ কমিশন তাদের এসব কাজের ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করবে।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মূলত যেখানে ক্ষমতা বেশি, অপরাধ বেশি, ব্যবসা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেশি, সেসব এলাকায় পদায়নের আলাদা চাহিদা রয়েছে। এর মূল কারণ, এসব জায়গায় অবৈধ আয়ের সুযোগ বেশি। কেবল ক্যাডার কর্মকর্তারা নন, কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পর্যন্ত পুলিশের প্রতিটি পর্যায়ের বেশির ভাগ সদস্য এসব এলাকায় পদায়ন পেতে চান। তাই পদায়নের ধারণায় পরিবর্তন জরুরি।
কেননা, পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের জন্য কোনো ‘ফিটলিস্ট’ (যোগ্য তালিকা) নেই। ফলে যেকোনো সময় যাকে খুশি যেকোনো জায়গায় পদায়নের সুযোগ রয়েছে। মূলত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পদায়ন ঘিরেই শুরু হয় পুলিশের রাজনীতি। আর এই রাজনীতিই পুলিশের পেশাদার বাহিনী হওয়ার ক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা।
তুলনামূলক ভালো পদে যেতে বাহিনীর প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কাছে ধরনা দিতে হয় অন্য কর্মকর্তাদের। কোথাও কোথাও আবার স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের চাওয়া অনুযায়ী পদায়ন হয়। কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আবার সিন্ডিকেট তৈরি করে বদলি-পদোন্নতির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করেন। এ জন্য তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। কখনো আবার পদায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অবৈধ অর্থ লেনদেন। এ কারণে পদায়নে কখনোই শৃঙ্খলা আসে না।
এদিকে পদায়নে শৃঙ্খলা আনতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নেরও দাবি উঠেছে পুলিশের অভ্যন্তরে। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শ হলো- প্রশাসন ক্যাডারে যেভাবে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদোন্নতির জন্য ‘ফিটলিস্ট’ করা হয়, সেভাবে পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে পদায়নের জন্যও ফিটলিস্ট করতে হবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে পদায়নের জন্যও ফিটলিস্ট থাকতে হবে। এসব পদে যেতে বিশেষায়িত ও সুনির্দিষ্ট জায়গায় কাজের অভিজ্ঞতা যুক্ত করে দিতে হবে।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, এসপি ও ওসি পদে কতদিন থাকতে পারবেন, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। বিশেষায়িত ইউনিটগুলো ছাড়া অন্য সব ইউনিটে সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে ভালো-খারাপ পদায়ন বলে কিছু থাকবে না। তাহলে সবার সব জায়গায় কাজ করার মানসিকতা তৈরি হবে। থানা সংস্কারেরও তাগিদ দিয়েছেন পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ব্যাপারে তাদের পরামর্শ, প্রতিটি থানার পুলিশ সদস্যদের সার্বক্ষণিক কার্যক্রম তদারকির জন্য স্বাভাবিক নজরদারির বাইরেও জেলাগুলোতে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র দল থাকবে। তারা প্রতিদিনের অসঙ্গতিগুলো তুলে এনে সরাসরি এসপি এবং রেঞ্জ ডিআইজিকে প্রতিবেদন দেবেন। এ ছাড়া প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো অবৈধ লেনদেন হয়েছে কিনা বা কেউ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা জানতে চাইবেন। সে অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া কনস্টেবল নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে পুলিশের জবাবদিহির কাঠামো গড়ে তোলারও তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। তাদের ভাষ্য, পুলিশ সদস্যদের অধিকাংশ অপরাধের নেপথ্যেই রয়েছে ঘুষ ও অবৈধ লেনদেন। এর বাইরে সাধারণত আচরণগত, ব্যক্তিগত ও দায়িত্বে অবহেলার ঘটনায় পুলিশ সদস্যরা অভিযুক্ত হন। তবে আলোচিত না হলে খুব কম ঘটনার ক্ষেত্রে অভিযুক্ত সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। আবার যেসব তদন্ত হয়, সেগুলোও পুলিশই করে থাকে। ফলে নানা কৌশলে বড় অপরাধ করেও লঘু শাস্তি কিংবা অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যান অপকর্মে জড়ানো পুলিশ সদস্যরা। এ অবস্থায় পুলিশের জবাবদিহির জন্য শক্ত কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। সংস্কারের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে মনে করেন তারা।
Leave a Reply