নতুন জন্মনিবন্ধন বা নিবন্ধিত জন্মসনদ সংশোধন, এমনকি নাগরিক সনদ নিতেও সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে কয়েকগুণ বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সচিবদের বিরুদ্ধে। এসব নাগরিক সেবা পেতে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা। বিড়ম্বনা এড়াতে বাধ্য হয়েই বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। সনদের জন্য অনেকের কাছ থেকে নানা অজুহাতে এক হাজার টাকা বা তার বেশিও নেওয়া হচ্ছে।
জন্মনিবন্ধন ও সংশোধন করতে সরকারি ফি ৫০ ও ১০০ টাকা। ভুক্তভোগীরা জানান, তবু এসব সনদের জন্য কয়েক গুণ বেশি টাকা নেওয়া হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, নাগরিক সেবার নামে দুর্নীতি ও ঘুষ লেনদেন চলছে।
এসব অভিযোগের প্রমাণ মেলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৫-এর বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে। সরেজমিন দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে ওয়ার্ড সচিব ও অফিস সহকারীরা।
গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যায়, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর ওয়ার্ডের কার্যক্রম চলছে পশ্চিম তেজতুরী বাজার এলাকার হালিম কমিউনিটি সেন্টারের চারতলায়। ওইদিন দুপুরে সেখানে দেখা যায়, সিটি করপোরেশনের সেবা নিতে প্রায় ২৫ জন অপেক্ষা করছেন। তাদের বেশিরভাগই জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত কাজে এসেছেন। কথা হয় কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। তারা বলছেন, টাকা ছাড়া কোনও সেবা দিচ্ছেন না ওয়ার্ড সচিব দ্বীন ইসলাম। তিনি নাগরিক সনদের জন্য ১০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নিচ্ছেন। আর জন্মনিবন্ধন নতুন কিংবা সংশোধনের জন্য ২০০ থেকে দুই হাজার করে টাকা নিচ্ছেন।
সাইফুল ইসলাম নামে এই ওয়ার্ডের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমার মেয়ের জন্মনিবন্ধন সংশোধন করার জন্য আবেদন করেছি। তারা বলেছেন, জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে যেতে হবে সদরঘাটে ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। আমি না গেলে তাদের এক হাজার টাকা দিতে হবে। আমি চাকরি করি, ওদিকে যাওয়া একটু কঠিন। ঝামেলা এড়াতে এক হাজার টাকা দিয়েছি।’
একই অভিযোগ করেন নাখালপাড়ার বাসিন্দা সালমা পারভীন বলেন, জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে আমার কাছ থেকে এক হাজার টাকা নিয়েছে। বলেছিল এক সপ্তাহ পরে দেবে। অথচ ১৫ দিন হয়ে গেছে, এখন বলছে হয়নি। টাকা কে নিয়েছে জানতে চাইলে ওয়ার্ড সচিবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর আগে কাউন্সিলর শামিম থাকাকালীন আমার ছেলের জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে এসেছিলাম। তখন ২৫ হাজার টাকা চেয়েছিল এই ওয়ার্ড সচিব। তখন আমি কাউন্সিলর শামিমের কাছে গেলে তিনি বলেন, এই কাজ হবেই না। এরপর সারোয়ার নামে তাদেরই একজন ৩০ হাজার টাকার নিয়ে সংশোধন করে দেয়।’
অভিযোগ আছে, ওয়ার্ড সচিব দ্বীন ইসলাম অফিস সহকারী মো. হোসেন ও খাদিজাকে নিয়ে এই অনিয়ম কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে কাউন্সিলর থাকাকালীন এই সচিব আওয়ামী লীগ নেতা রবিন ও সারোয়ারের মাধ্যমে একটি অনিয়ম ও দুর্নীতির বলয় গড়ে তুলেছিলেন। তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমন অনিয়ম নিয়ে কেউ কাউন্সিলরের কাছে অভিযোগ দিলে উল্টো তাকে সেবা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হতো। গত বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায় সারোয়ার সিন্ডিকেটের সবুজ নামে এক সদস্যকে। জন্মনিবন্ধন ও নাগরিক সনদের বাইরে অন্যান্য সেবা নিতে যারা আসেন, তাদের সঙ্গে টাকা-পয়সার বিষয়টি দেখেন এই সবুজ।
এসব অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড সচিব দ্বীন ইসলাম বলেন, ‘সরকার থেকে আমাদের কোনও কিছু দেওয়া হয়নি। নিজের টাকায় প্রিন্টার, কালি ও কাগজ কিনতে হয়। তাই অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়।’ হাজার হাজার টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা যাতায়াত খরচ বাবদ নেওয়া হয়। আমাদের সদরঘাট ও মোহাম্মদপুরে যেতে হয়। সরকার কোনও বাজেট দেয় না।’ডিএনসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড সচিবের দফতর একই চিত্র দেখা যায় নগরীর আরও কয়েকটি ওয়ার্ডে। উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাজ চলছে মোহাম্মদপুর আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ২ নম্বর রোডের ২৯৯/এ নম্বর বাড়ির দোতলায়। রবিবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, এখানে জন্মনিবন্ধন নতুন কিংবা সংশোধন এবং নাগরিক সনদ দিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছেন ওয়ার্ড সচিব মাহবুবুল হক।
শম্পা নামে এক বাসিন্দা তার কোলের বাচ্চা নিয়ে ওয়ার্ড অফিসে এসেছেন জন্মসনদ সংশোধন করার জন্য। তার কাছ থেকে আবেদনের জন্য সাড়ে তিনশ’ টাকা নিয়েছেন ওয়ার্ড সচিব মাহবুবুল হক। আর ডিসি অফিস থেকে সংশোধন করে আনতে আরও এক হাজার টাকা দিতে হবে বলে জানিয়েছেন শম্পাকে। এ ব্যাপারে সেবাগ্রহীতা শম্পা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পাসপোর্ট করার জন্য আমার এবং আমার পরিবারের সবার জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে হবে। এখানে প্রতিটি সংশোধনের আবেদন ফি চাইছে সাড়ে তিনশ’ টাকা। আর তারা বলছেন, এটা ঢাকা জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে করে আনতে হবে। তারা গেলে প্রতিটির জন্য এক হাজার টাকা করে দিতে হবে। আর নয়তো আমাকে ডিসি অফিসে নিজে যেতে হবে।’
একই অভিযোগ পাওয়া যায় আরও কয়েকজন বাসিন্দার কাছ থেকে। ওয়ার্ডের আরেক বাসিন্দা রাব্বি বলেন, ‘আমার ভাসতি সাফরিনের জন্মনিবন্ধন সংশোধন করার জন্য অনলাইনে আবেদন করেছি। অনলাইনেই টাকা দিয়েছি। এখানে আসার পর বলছে আবেদনের জন্য সাড়ে তিনশ’ টাকা লাগবে। আর ডিসি অফিস থেকে ছাড়িয়ে আনতে আরও এক হাজার টাকা লাগবে।’ সরকারি ফির বাইরে কেন অতিরিক্ত টাকা দিচ্ছেন- এমন প্রশ্নে ওই বাসিন্দা বলেন, এটা বলে লাভ নাই। এটা আমার দুর্ভাগ্য। আমাদের সরকারি সার্ভিসগুলোই এমন। প্রতিবাদ করলে বরং আমার কাজটা আটকে রাখবে। ১২ দিন আগে দিয়েছি। এখনও বলছে কাজ হয়নি।’
এসব অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড সচিব মাহবুবুল হক বলেন, ‘সরকার থেকে আমাদের কোনও লোক দেওয়া হয়নি। আমার পকেটের টাকা দিয়ে একজন কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস স্টাফ রাখা হয়েছে। তাদের তো খরচ আছে। এজন্য সংশোধনের আবেদন ফির সাড়ে তিনশ’ টাকা রাখা হয়। এর মধ্যে ১০০ টাকা সরকারি ফি দিতে হয়।’ ডিসি অফিসে যাওয়ার কথা বলে এক হাজার টাকা কেন নেওয়া হচ্ছে- এমন প্রশ্নে ওয়ার্ড সচিব বলেন, ‘আমি তো ডিসি অফিসে যাই না। যারা যায় তাদের আসা-যাওয়ার খরচ আছে।’
একই অভিযোগ পাওয়া যায় ডিএনসিসি অঞ্চল-৫-এর ২৯ নম্বর আরেকটি ওয়ার্ডেও। এ ওয়ার্ডে কাজ চলছে মোহাম্মদপুর সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে নিচতলায়। সেখানে কথা হয় কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। তারা বলেন, ‘জন্মনিবন্ধন সংশোধনের এখন অনেক ঝামেলা করছে সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড সচিব ও স্টাফরা।
মিজানুর রহমান নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘সরকারি কাজ মানে অতিরিক্ত টাকা। জন্মনিবন্ধন করতে টাকা, নাগরিক সনদ নিতে টাকা। চাকরির জন্য সিটি করপোরেশনের কাগজ লাগে, সেটা নিতে টাকা। টাকা ছাড়া কোনোভাবেই নাগরিক সেবা পাওয়া যায় না। আমার বাচ্চার নিবন্ধন করতে পাঁচশ’ টাকা দিতে হয়েছে।’
গত রবিবার দুপুরে সূচনা কমিউনিটি সেন্টারে কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলার সময় অফিস তালাবদ্ধ করে চলে যান ওয়ার্ড সচিব মো. ইফতেখারুল ইসলাম। পরে ওয়ার্ড সচিবের সঙ্গে কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
ওয়ার্ডগুলোতে এমন অনিয়মের অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা (উপসচিব) মোতাকাব্বীর আহমেদ। তবে এর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও জনবল সংকটের সুযোগে এমন অনিয়ম হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কাছেও ওয়ার্ড সচিবদের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। আমরা এসব বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ জন্মনিবন্ধনের আবেদন ফি অনলাইনে দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার অনলাইনে আবেদন ও টাকা পরিশোধে ব্যবস্থা করেছে। সরাসরি লেনদেনের কোনও সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের আরও সতর্ক হতে হবে। কোনও ওয়ার্ডে অতিরিক্ত টাকা চাইলে, সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা কোনও প্রকার হয়রানি করলে সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করতে হবে। তাহলে দুর্নীতি রোধ করা যাবে।’
ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (স্থানীয় সরকার) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, জন্মনিবন্ধন সংশোধন করতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কোনও অর্থ লেনদেন হয় না। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড থেকে অনলাইনের মাধ্যমে আবেদন আমাদের কাছে আসার দুদিনের মধ্যে সংশোধন অনুমোদন করে আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে আসার কোনও প্রয়োজন নেই। এরপরও কারও খুব জরুরি প্রয়োজন থাকলে, এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে অনুমোদন করে দেওয়া হয়। অর্থ লেনদেনের কোনও সুযোগ নেই।
অভিযোগ রয়েছে ওয়ার্ডগুলোতে নাগরিক সেবা দিতে কাগজ, প্রিন্টারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং কোনও কম্পিউটার অপারেটর সিটি করপোরেশন থেকে দেওয়া হয়নি। এছাড়াও ওয়ার্ড অফিস থেকে সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে আসা-যাওয়ার জন্য কোনও খরচও দেওয়া হয় না। আর এই সুযোগে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে– এমন প্রশ্নে উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ সব কিছুই দেওয়া হয়। ওয়ার্ডগুলোকে মাসিক একটি খরচ দেওয়া হয়। এরপরও আসা-যাওয়া ও অন্যান্য খরচের জন্য বিল করে জমা দেওয়ার জন্য বলা আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নাগরিক সেবায় হয়রানি করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। নাগরিকদের প্রতিটি অভিযোগ আমলে নিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
Leave a Reply